যত দিন যাচ্ছে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আরও বড়, আরও শক্তিশালী সব টেলিস্কোপ নির্মাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা, পৃথিবীর বাইরের জগৎটাকে হয়তাে এর ফলে আরও ভালাে করে বােঝা যাবে। ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তু এবং ডার্ক এনার্জি বা গুপ্তশক্তির অস্তিত্বের কথা তাত্ত্বিকভাবে অনেক আগে থেকেই জানেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সত্যি সত্যি এদের আজও মুঠোয় পারা যায়নি। আদৌ কোনাে দিন যাবে কি না, আমরা জানি না। কিন্তু আশা তাে করতেই পারি। এত দিনের চেষ্টায় নিউট্রিনােকে শনাক্ত করেছি আমরা, তুলেছি কৃষ্ণগহ্বরের ছবি। পর্যবেক্ষণভিত্তিক এই বিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিতে চাই আরও শক্তিশালী যন্ত্র।
আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং সেনাবাহিনী মহাকাশ বিজ্ঞানের পেছনে যে পরিমাণ ফান্ডিং দিত, পৃথিবীর আর কোনাে দেশ তা দিত না। এখন দিন বদলাচ্ছে। বাকি দেশগুলােও ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করছে চীন ও ভারত। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলাে একে অন্যকে সহায়তাও করছে। সবই আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলা!
তাতে অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য ভালােই হয়েছে। তারা বড় অঙ্কের বাজেট পাচ্ছেন, কাজও করতে পারছেন সে রকম। এ রকমই বিশাল বাজেটে, বিশালাকৃতির একটি টেলিস্কোপ তৈরি হচ্ছে সাম্প্রতিক কালে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপগুলাের একটি এই লার্জ সিনােপটিক সার্ভে টেলিস্কোপ (LSST)।
১
চিলির কেরাে প্যাচো পর্বতের চূড়ায় পুরােদমে কাজ চলছে। দিন-রাত খেটে যাচ্ছেন শ্রমিকেরা। ১৬ বছরের পরিকল্পনার পর ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা অবশেষে এলএসএসটি টেলিস্কোপের ৩.২ গিগাপিক্সেল সেন্সর অ্যারের কাজ শেষ করেছেন। সহজ কথায়, এটি হলাে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা। কিন্তু ক্যামেরার লেন্স ও সেন্সর ছাড়াও আরও অনেক কিছু তাে আছে! সেগুলাের সব কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে। হিসাবমতে, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে টেলিস্কোপটির ১০ বছরব্যাপী সার্ভে কাজ শুরু করতে পারবে। তারপর? আমাদের জানা পুরােটুকু আকাশজুড়ে চোখ বােলাতে এর লাগবে মাত্র কয়েক রাত!
ধারণা করা হচ্ছে, এটি মহাবিশ্বের সবচেয়ে গভীর ও বিস্তৃত ছবি দিতে পারবে। কথা হলাে, কাজটা সে করবে কীভাবে?
সহজ ভাষায় বললে, একটি টেলিস্কোপকে বোঝার জন্য তিনটি জিনিস ভালােভাবে বােঝা লাগবে। এক. মিরর সিস্টেম, দুই, ফিল্ড অব ভিউ এবং তিন. ক্যামেরা।
মােট তিনটি আয়না নিয়ে গড়ে উঠেছে এলএসএসটির সম্পূর্ণ থ্রি-মিরর সিস্টেম। এটা মূলত 'পল-বেকার থ্রি-মিরর অ্যানাস্টিগম্যাট' নামে একধরনের ব্যবস্থার ওপর নির্মিত। এর ফলে এক বা দুই আয়নার টেলিস্কোপের চেয়ে অনেক স্পষ্ট ও অবিকৃত ছবি পাওয়া যাবে। এখানে প্রথম ও তৃতীয় আয়নাটি মূলত একটি কাচ দিয়েই তৈরি। ফলে এর মােট দৈর্ঘ্য আর অযথা বেড়ে যায়নি। তারপরও এর আয়নাগুলাের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য হয়েছে ৮ দশমিক ৩ মিটার। মানে পুরাে একটি টেনিস কোর্টের সমান!
এটি ব্যবহার করে আকাশের ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রিজুড়ে ছবি তুলতে পারবে এলএসএসটি। এই ফিল্ড অব ভিউটা। কত বড়, একটা উদাহরণ দিলে বােঝা যাবে। সূর্য ও চাঁদকে পৃথিবী থেকে থেকে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রিজুড়ে দেখা যায়। আর মােটামুটি সাধারণ ফিল্ড অব ভিউ হয় সাকল্যে ডিগ্রি। এত বিশাল ফিল্ড অব ভিউর ছবি যে বিজ্ঞানীদের দারুণ কাজে আসবে, কি আর আলাদা করে বলার প্রয়ােজন আছে?
তার ওপরে আছে ৩ দশমিক ২ গিগাপিক্সেল ক্যামেরা! কথাটা ভালােভাবে বােঝার জন্য মেগাপিক্সেলে ভেঙে বললে কী দাঁড়াবে, ভাবুন তাে। ৩ হাজার ২০০ মেগাপিক্সেল! এই কৃত্রিম চোখটি ১০ বছর ধরে ৩৭ বিলিয়ন গ্যালাক্সি এবং নক্ষত্রের ওপর চোখ বােলাবে। প্রতি ২০ সেকেন্ডে ১৫ সেকেন্ড এক্সপােজারের একটি করে ছবি তুলবে এটি। ফলে এক রাতের মধ্যেই জমা হবে প্রায় ২০ টেরাবাইটের মতাে তথ্য! এই হিসাবে এক বছরে এটি দুই লাখের মতাে ছবি তুলতে পারবে।
২
এলএসএসটির মােট চারটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে। প্রথমটি হলাে, সৌরজগতের বিভিন্ন বস্তুর আরও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে সাহায্য করা। খ্রিষ্টপূর্ব ৯৬৪ সালে পার্সিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবদ্-আল-রাহমান আল-সুফির লেখা বুক অব ফিক্সড স্টারস-এর হাত ধরে এই কাজ শুরু হয়েছিল। তারপর কত শত ভূ-টেলিস্কোপ, নভােটেলিস্কোপ নিয়ে কাজ করেছে!
সেই লম্বা তালিকায় এবার যােগ দিতে যাচ্ছে এলএসএসটি। এর দ্বিতীয় কাজ হলাে, নিরবধি পরিবর্তনশীল আকাশের বিভিন্ন বস্তু আবিষ্কার করা। কী ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, সেগুলাে খেয়াল রাখা। প্রতিবছর একই জায়গা থেকে আকাশের বিভিন্ন জিনিসের দুই লাখ ছবি তােলার অর্থ, সুপারনোভা বা গামা রশ্মির বিস্ফোরণ কিংবা বিচিত্র সব জিনিস চিহ্নিত করার জন্য এটি একেবারে আদর্শ। সেই সঙ্গে সৌরজগতের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চল, কুইপার বেল্টের শত-সহস্র নতুন বস্তুকেও এটি চিহ্নিত করতে পারবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
সৌরজগৎ শেষ করে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের আরও পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরিতে বিজ্ঞানীদের এটি সাহায্য করবে। ছােট, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভিন্ন বস্তুর যে স্পষ্ট ছবি তােলার ক্ষমতা এলএসএসটির আছে, আগের কোনাে টেলিস্কোপেরই তা ছিল না। এ থেকে মিল্কিওয়ের সৃষ্টি ও গঠনের ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে ভাবছেন বিজ্ঞানীরা।
আমাদের গ্যালাক্সি শেষ করে বিভিন্ন গ্যালাক্সি নিয়েও। কাজ করবে এই টেলিস্কোপ। গুপ্তবস্তু ও গুপ্তশক্তির রহস্যের কিনারা করার জন্য সূত্র খুঁজে বেড়াবে এই কৃত্রিম চোখ। বিশেষ করে, গ্যালাক্সি প্রথম গঠিত হওয়ার সময় গুপ্তবস্তু এর ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সে ব্যাপারে কিছু হলেও জানা যাবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা। এখন শুধু অপেক্ষা!
লেখক : উচ্ছাস তৌসিফ,
শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্র : বিবিসি ফোকাস
সংগৃহীত : বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন