ধান গবেষণায় ক্রিসপার - Storybd3

Latest

বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র

বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

ধান গবেষণায় ক্রিসপার



ছেলেবেলায় রংতুলি নিয়ে খেলা করা ছােটদের অনেক পছন্দের কাজ। শিশুরা কল্পনায় ভেসে ওঠা দৃশ্যকে রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তােলে কাগজের ক্যানভাসে, একেবারে নিজের খেয়াল-খুশিমতাে, ব্যাকরণের ধার না ধেরে। কখনাে হয়তাে লাল টমেটোকে বেগুনি রঙে আঁকে, আবার কখনাে হয়তাে ছােট আলুকে কুমড়ার মতাে বড় করে দেখায়। এসব তার শিশুমনে উকি দেওয়া নানা প্রশ্নেরই ফল। ওরা ভাবে, আচ্ছা যদি এমন জাদুশক্তি থাকে, যার সাহায্যে ছােট ছােট ফল বিশাল আকারের হয়ে ওঠে অথবা সাধারণ সবুজ রঙের ফলকে যদি নানা রঙে রঙিন করে তােলা সম্ভব হয়, তাহলে কেমন হয়? এখন এসব আর দূর কল্পনার বিষয় নয়। জিনবিজ্ঞানে এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে, যার সাহায্যে খুব সহজেই উদ্ভিদের রং, আকার কিংবা চরিত্র বদলে ফেলা যায়। সেই পদ্ধতির নাম ক্রিসপার।

ক্রিসপার কী, তা বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে জিন সম্পর্কে। পৃথিবীতে সব জীবকোষের ভেতরে থাকে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবােনিউক্লিক অ্যাসিড)। এটা আসলে একটি প্যাচানাে দ্বিসূত্রক নকশা। এই নকশার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে জীবনের নীলনকশা। জিন হচ্ছে ডিএনএর ছােট একটা অংশ, যে অংশ জীবের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। ধরা যাক, আপনার চুল কালাে আর তােমার বন্ধুর চুল সােনালি। এর কারণ হলাে আপনাদের চুলের রঙের জন্য দায়ী জিনটা আলাদা। আরেকটু গভীর থেকে জিনকে পর্যবেক্ষণ করা যাক। জিনের ভেতরে আছে চার ধরনের নিউক্লিওটাইড A, T, C, G-এর ব্লক। এই চার ধরনের নিউক্লিওটাইড নিজেদের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত হয়ে তৈরি করে আলাদা বৈশিষ্ট্যের জিন। মনে করুন, আপনার আর আপনার বন্ধুর চুলের রঙের জন্য দায়ী জিনের মধ্যে সাদৃশ্য ৯৯.৯৯ শতাংশ। শুধু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আপনার জিনে আছে A আর আপনার বন্ধুর জিনে আছে G। মাত্র একটা নিউক্লিওটাইডের পরিবর্তনের জন্য আপনার চুলের রং কালাে আর বন্ধুরটা সােনালি। এখন আপনার ডিএনএতে যদি ছােট্ট একটা মিউটেশন (জিনের পরিবর্তন) করা সম্ভব হতাে, তবে সহজেই আপনার চুল সােনালি হয়ে যেত।

আগে হয়তাে এটা অসম্ভব ছিল, এখন এটা খুব সহজেই faras (Crispr- Clustered regularly interspaced short palindromic repeats) পদ্ধতিতে করা সম্ভব। ক্রিসপার হচ্ছে সেই অদৃশ্য কাঁচি, যা দিয়ে জিনের কিছু অংশ কেটে ফেলা সম্ভব। জিনে পরিবর্তন করা যেন এখন বিজ্ঞানীদের কাছে ছােটবেলার রংতুলির মতাে। ক্রিসপার দিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন মানুষের ডিএনএর ত্রুটিপূর্ণ জিনকে সরিয়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়া শস্যের গুণাগুণ উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে এই পদ্ধতি। ক্রিসপার পদ্ধতির মূল জিনিস হচ্ছে ২০ নিউক্লিওটাইড-বিশিষ্ট আরএনএ (একসূত্রক গাইড RNA)। এটা খুঁটির মতাে টার্গেট জিনে বসে যায়। অন্যদিকে ক্যাস৯ (Cas9) নামের একটি প্রােটিন কাঁচির মতাে কাজ করে। ধরা যাক, আপনার একটা বাগান আছে। আপনি একটা সুন্দর টমেটোগাছ লাগাতে চান সেই বাগানে। কিন্তু বাগানের মাটি লবণাক্ত। লবণাক্ত মাটিতে তাে টমেটো জন্মায় না। ক্রিসপার পদ্ধতিতে আছে এর সমাধান। জিনবিজ্ঞানীরা টমেটোর ডিএনএতে লবণ সংবেদনশীলতার দায়ী জিনটিকে প্রথমে খুঁজে বের করবেন। তারপর ডিএনএ থেকে ক্যাস৯-এর মাধ্যমে জিনটিকে সরিয়ে ফেললেই পাওয়া যাবে লবণসহনশীল টমােটাগাছ।

পুরাে প্রক্রিয়াটা একবার দেখে নেওয়া যাক। প্রথমে লবণ সংবেদনশীল জিনকে (টার্গেট জিন) খুঁজে বের করতে হবে। এরপর করতে হবে টার্গেট জিনের জন্য নির্দিষ্ট জিআরএনএ (GRNA) ডিজাইন। এই ডিজাইন করতে গিয়ে দুটো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। এক, সিডিএস (Coding Region), এটা জিনের ভেতরে প্রােটিন তৈরির তথ্য বহন করে এবং দুই. প্যাম সিকোয়েন্স (PAM Sequence), এটাই ঠিক করে দেয় জিআরএনএ কোন জায়গায় টার্গেট জিনের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। একজন অন্ধ লােক যেমন লাঠির সহায়তা নিয়ে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছায়, প্যাম সিকোয়েন্স তেমন জিআরএনএকে নিয়ে গিয়ে টার্গেট জিনের নির্দিষ্ট স্থানে সংযুক্ত করে দেয়। এর পরের কাজটা হলাে ক্যাস৯ প্রেটিনের। এই প্রোটিন টার্গেট জিন, যেখানে জিআরএনএ সংযুক্ত জায়গাটা খুঁজে বের করে। তারপর অদৃশ্য কাচির মতাে ওই জায়গাটা কেটে দেয়। এরপর টমেটোগাছ নিজস্ব মেরামত প্রক্রিয়ার সাহায্যে সেই অংশটাকে সারিয়ে নেয়। এভাবে খুব সহজভাবেই একটি লবণসহনশীল টমেটোগাছ তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু কিছু বাকি এখনাে রয়ে গেছে। আপনি যে জিআরএনএ এবং ক্যাস৯ ব্যবহার করলেন জিন এডিটিংয়ের জন্য সেগুলাে কোথেকে এল। নিশ্চয়ই প্রাকৃতিকভাবে তা টমেটোগাছের ডিএনএতে ছিল না?

ক্রিসপারের ধারণা বিজ্ঞানীরা পেয়েছিলেন ব্যাকটেরিয়ার শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থেকে। বিজ্ঞানীরা দেখেন, ব্যাকটেরিয়া যখন কোনাে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সে নিজের দেহে ক্রিসপার নামের প্রক্রিয়াটি সক্রিয় করে দেয়। ফলে ক্যাস৯ প্রোটিন ভাইরাল ডিএনএকে শনাক্ত করে এবং একে ধ্বংস করে দেয়। ক্যাস৯-এর এই ডিএনএ কাটার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা জিনােম এডিটিংয়ের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছেন। যেহেতু জিআরএনএ, ক্যাস৯- এর জিন প্রাকৃতিকভাবে জীবের ভেতরে থাকে না, তাই বাইরে থেকে এগুলাের জিন ক্লোন করতে হয়। তারপর একে উদ্ভিদ দেহে ট্রান্সফরমেশনের (transformation) মাধ্যমেই সম্ভব টমেটোছটির ভেতর ক্রিসপার প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করা।

অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম (Agrobacterium) নামে একটা ব্যাকটেরিয়া আছে। এই ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নাম ওতপ্রােতভাবে জড়িত। এই ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই যেকোনাে ডিএন গাছের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে। এর মাধ্যমেই ক্রিসপার পদ্ধতিকে উদ্ভিদের দেহের ভেতর প্রবেশ করানাে যায়।

আমি নিজেও ক্রিসপার আর অ্যাগ্রোব্যাকটেরিয়াম নিয়ে কাজ করেছিলাম বছর দুয়েক আগে। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখি, কীভাবে ক্রিসপার লবণাক্ত পানিতে ধানগাছ জন্মানাে যায়। লবণ পানির মূল ক্ষতিকর উপাদান সােডিয়াম ক্লোরাইড নলের মতাে অনেকগুলাে চ্যানেলের মাধ্যমে ধানগাছে প্রবেশ করে। ফলে ধানগাছ বড় ধরনের শক অনুভব করে এবং মারা যায়। আমি এ রকম একটা সােডিয়াম বহনকারী সরু নলকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য ক্রিসপার ব্যবহার করছি। যদি সােডিয়াম বহনকারী সরু নলই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তাহলে ধানগাছে বিষ ঢুকবে কীভাবে? এভাবেই বেঁচে যাবে ধানগাছ লবণ পানির ভয়াবহতা থেকে।

লেখক :  আয়শা আক্তার,
 রিসার্চ অ্যাসােসিয়েট প্ল্যান্ট বায়ােটেকনােলজি ল্যাবরেটরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সংগৃহীত : বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিন

1 টি মন্তব্য: