বন ওকড়া - Storybd3

Latest

বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র

শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২০

বন ওকড়া





বনের গাছ বন ওকড়া। অন্য নাম জংলি ঘাগড়া। ইংরেজি নাম অর্মেনিয়া ফাইবার, সিজারউইড ও কঙ্গো জুট। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Urena lobata L. পরিবার মালভেসি। জবা-ঢ্যাঁড়স পরিবারের এই বুনাে গাছ রাস্তার ধারে, নদীর পাড়ে, ঝােপঝাড়ে আগাছার মতাে জন্মে। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এ গাছের দেখা মেলে। না আছে গাছের কোনাে কদর, না আছে ফুলের কোনাে রূপ। প্রায় সবার কাছেই বুনাে ওকড়াগাছ যেন এক বালাই, একবার কোথাও গেড়ে বসলে তাকে উচ্ছেদ করা মুশকিল। অথচ বুনাে এই গাছের আছে। অনেক ঔষধি গুণ। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বন ওকড়ার ঔষধি গুণ ও রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণের ওপর অনেক গবেষণা হয়েছে ও বিভিন্ন গবেষণাপত্রে সেসব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সায়েন্স ডাইরেক্ট, গুগল রিসার্চ, পাবমেড ইত্যাদি ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সেসব তথ্যসূত্রে জানা গেছে, এই গাছে রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাভিনয়েড, গ্লাইকোসাইড, টারপিনয়েড ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এসব রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির কারণে বন ওকড়া জীবাণু রােধকারী, ক্যানসার প্রতিরােধী, অ্যান্টিডায়াবেটিক, অ্যান্টিলিপিডেমিক হিসেবে কাজ করে।

এই গাছ পথ চলতে বনজঙ্গলে ঘুরতে আমাদের অনেকেরই চোখে পড়ে। এমনকি তিলােত্তমা ঢাকা শহরের বুকেও রয়েছে বুনাে ওকড়ার উপস্থিতি। জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানে শরৎ-হেমন্তের দিনগুলােতে হাঁটতে গিয়ে বহুবার দেখা হয়েছে বন ওকড়ার সঙ্গে। সেই দেখা পত্রপুষ্পশােভিত রূপে। অনেকটা পাটগাছের মতাে কাণ্ড বা ডালপালা, কিন্তু পাতাগুলাে তুলাগাছের মতাে। পাতার কিনারা তিনটি খাঁজে বিভক্ত।
 ফুল ছােট, পাতার কাল থেকে ফোটে। পাপড়ি পাঁচটি ছড়িয়ে থাকে একটা পিরিচের মতাে, হালকা গােলাপি রং, মাঝখানটা একটু গাঢ় লাল, কেন্দ্র থেকে ছােট্ট একটা দণ্ডের মতাে উকি দেয় জননাঙ্গ।

মৌসুমে গাছে অনেক ফুল ফোটে, ফুলে আসর বসে মৌমাছিদের। সকালবেলা ফুল ফোটে, দুপুরেই ঝিমিয়ে পড়ে। ফলের আকার অনেকটা ছােলাবুটের মতাে, কিছুটা গােলাকার, অগ্রভাগে একটা হুকের মতাে একটা অঙ্গ থাকে, অনেকটা ঘাগড়া ফলের মতাে। এ কারণে ফল কাপড়ে লাগলে আটকে যায়। 
এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বীজ ছড়িয়ে পড়ে। বীজ থেকে সহজে চারা হয়। কঙ্গো অববাহিকায় এ গাছ বেশি জন্মে বলে এর আরেক নাম কঙ্গো পাট। পাটের মতােই এ গাছ থেকে আঁশ হয়। এ আঁশের উজ্জ্বলতা ও মসৃণতা পাটের চেয়ে বেশি। এমনকি এ গাছের আঁশ উইপােকা ও পানি প্রতিরােধী। আঠারাে শতকে অনেক ইউরােপীয় নাবিক এ গাছের আঁশ দিয়ে দড়ি বানিয়ে তা জাহাজে ব্যবহার করতেন। বীজে আছে ৭ শতাংশ তেল, এই ফ্যাট বা তেল থেকে সাবান

তৈরি করা যায়। বন ওকড়াগাছের শিকড়, পাতা ও ফুল বিভিন্ন রােগের চিকিৎসায় প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর শিকড় স্বাদে তেতাে ও কটু। শিকড় আন্ত্রিক ক্ষত সারায়, বেটে মলমের মতাে ব্ৰণে লেপে দিলে উপকার হয়। রক্তার্শ সারাতেও এটি ব্যবহার করা হয়। এর পাতা, ফুল ও ফল স্বাদে কইষট্যা ও পিচ্ছিল, অনেকটা জবা ও ঢাড়সগাছের পাতার রসের মতাে। শিকড় ও পাতার রস পেটের বিভিন্ন অসুখ, বিশেষ করে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে জ্বালাপােড়া নিরাময় করে। এর পাতা ও ফুল কুষ্ঠরােগ চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। ফুল চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে মেহ রােগের উপশম হয়। বন ওকড়ার ফল খেলে প্রসূতির প্রসববেদনা বাড়ে। পাতা রক্ত পড়া বন্ধ করে ও ক্ষত সারায়। পাতা ও কাণ্ডের ছাল বেটে গরম করে সেঁক দিলে অর্বুদের ফোলা ও জ্বালাপােড়া কমে। বন ওকড়ার ডালপাতা বেটে মলমের মতাে করে কপালে লেপ দিলে মাথাব্যথা কমে। পুরাে গাছ ঘেঁচে তা লাগালে ভাঙা ও মচকা ব্যথা কমে। ফাইলেরিয়া বা গােদ রােগেও এ গাছের পাতা কার্যকর। পাতা চিবিয়ে তা গােদের ওপর লেপে দিলে। ফোলা কমে। এ গাছের ডাল দাঁতনের মতাে নিয়ে দাঁত মাজলে বা ব্রাশ করলে দাতব্যথা কমে। বাকল ছেঁচে কাটা জায়গায় লাগালে সেসব ক্ষত দ্রুত ভালাে হয়ে যায়। শুষ্ক কাশি সারাতে বন ওকড়া ফুলের ক্বাথ বা শরবত কয়েক দিন খেতে হবে। টনসিল ও গলাব্যথায় ফুল পানিতে জ্বাল দিয়ে সেই পানি দিয়ে গড়গড়া করলে উপকার পাওয়া যায়। কিছু ঝুঁকিও এ গাছের আছে। খুব পুরােনাে বা বয়স্ক গাছ টুকরাে করে কেটে তা দিয়ে সেদ্ধ করা ডিম গর্ভবতীকে খাওয়ালে তার গর্ভপাত হতে পারে। এর পাতা গনেরিয়া, ম্যালেরিয়া, জ্বর, ক্ষত, বাতব্যথা প্রভৃতি রােগ নিরাময়ে কাজে লাগে। এ গাছের পাতায় একধরনের আধা পরিশােধিত গ্লাইকোসাইড রয়েছে, যা ব্যথাবেদনা কমাতে সাহায্য করে। এ গাছের পাতার রস পরীক্ষা করে কেম্পেফেরল, কুয়ের্সেটিন ও টিলিরােসাইড নামে তিনটি রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই তিনটি রাসায়নিক উপাদান Escherichia coli, Bacillus subtilis Klebsiella pneumonia তিনটি ব্যাকটেরিয়ানাশক হিসেবে কাজ করে। ফলে এসব জীবাণুজনিত সংক্রমণ বন ওকড়াগাছের পাতার রস ব্যবহার করে কমানাে যায়। এ ছাড়া পাতায় আছে ১০ রকমের ফ্লাভিনয়েড যৌগ। এগুলাে হলাে কেম্পেফেরল, কুয়ের্সেটিন, রিউটিন, অ্যাফজেলিন, অ্যা্ট্রাজিন, টিলিরােসাইড ইত্যাদি। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা পাতা বিশ্লেষণ করে যেসব উপাদান পাওয়া গেছে, সেগুলাে হলাে জলীয় অংশ বা পানি ৮১ দশমিক ৮ শতাংশ, ৩ দশমিক ২ প্রােটিন, ১২ দশমিক ৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১ দশমিক ৮ গ্রাম খাদ্য আঁশ, ৫৫৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও ৬৭ মিলিগ্রাম ফসফরাস। এসব উপাদান থাকায় আফ্রিকার কোনাে কোনাে দেশে বন ওকড়ার কচি পাতা

শাক হিসেবে রেঁধে খাওয়া হয়, গরু-মহিষকেও খাওয়ানাে হয়। এর পাতা খেলে মহিষের দুধ বাড়ে।

লেখক  : মৃত্যুঞ্জয় রায়,
উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা
সংগৃহীত : বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন