রোগ প্রতিরোধে জিনের তথ্য - Storybd3

Latest

বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০

রোগ প্রতিরোধে জিনের তথ্য




আমাদের শরীর বিভিন্ন প্রকার রােগে আক্রান্ত হতে পারে, যেমন ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাল ইনফেকশন, বিভিন্ন জেনেটিক রােগ (ত্রুটিপূর্ণ জিন শরীরে থাকা), অর্গান ফেলিউর ইত্যাদি। যেকোনাে রােগের যথাযথ প্রতিকারের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়ােজন সঠিক সময়ে রােগনির্ণয়। কোনাে রােগ হওয়ার আগেই যদি তার ঝুঁকি কোনােভাবে চিহ্নিত করা যায়, তা হবে। আমাদের জন্য আরও ভালাে। এতে রােগ সংক্রমিত হওয়ার আগেই তা প্রতিরােধের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

কিছু রােগ বংশগত। অনেক সময় মা অথবা বাবার থেকে বংশানুক্রমে কোনাে ত্রুটিপূর্ণ জিন (জেনেটিক মলিকুল ডিএনএর অংশ) শিশুর শরীরে আসে। তাই শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব জিনের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন রােগের সঙ্গে সম্পর্কিত জিনগুলাে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, পারকিনসন, আলঝেইমার ইত্যাদি রােগের জন্য দায়ী অনেক জিন। কোনাে ব্যক্তির ডিএনএতে এসব রােগের কোনাে জিন আছে কি না, যদি পরীক্ষায় দেখা যায়, তাহলে তার ওসব রােগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাটা বােঝা যায় এবং আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিকার করা সম্ভব। আশার কথা হলাে, বিভিন্ন মলিকুলার টেকনিকের মাধ্যমে এসব জিন চিহ্নিত করা সম্ভব, যেমন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং, পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি।

১৯৯০ সালে শুরু হয় মানুষের ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রজেক্ট। শেষ করতে সময় লেগেছিল ১৩ বছর আর খরচ হয়েছিল প্রায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এখন রয়েছে আরও উন্নত ও দ্রুত ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করার পদ্ধতি। একে বলা হয় নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং যেমন, ইলুমিনা, আয়ন টরেন্ট, সলিড সিকোয়েন্সিং ইত্যাদি। এসব পদ্ধতিতে খুব কম খরচে, কম সময়ে, এমনকি এক দিনের মধ্যে পুরাে জিনােম সিকোয়েন্স করা সম্ভব।

বর্তমানে অনেকগুলাে কোম্পানি আছে, যারা বিভিন্ন রােগের ডায়াগনসিসের জন্য ডিএনএ থেকে তথ্য উদ্ঘাটন। ও বিশ্লেষণ করে। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ২৩অ্যান্ডমি (23andMe) কোম্পানিটি অন্যতম জনপ্রিয়। এই কোম্পানির নামই রাখা হয়েছে মানুষের ডিএনএ ২৩ জোড়া ক্রোমােজোমের সজ্জাক্রমের ওপর ভিত্তি করে। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি ৫০ লাখ মানুষের ডিএনএর ইনফরমেশন দিয়ে তৈরি করেছে সবচেয়ে বড় ডেটাবেস। কোম্পানিটি সাধারণ মানুষের ডিএনএ সিকোয়েন্স করে অর্থের বিনিময়ে। তারপর সেসব ডিএনএতে থাকা রােগ সৃষ্টিকারী জিন চিহ্নিত করে। এভাবেই তারা সাধারণ মানুষকে সেবা দেয়। তাদের সম্পর্কে জানতে ব্রাউজ করতে পারেন এই ঠিকানায় : www.23andme.com/?myg06=truel

ডিকোড (DeCODE) হলাে আরেকটি বড় জিনােমিক কোম্পানি (www.decode.com)। আইসল্যান্ডের ১০ হাজার ব্যক্তির ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করেছিল কোম্পানিটি। সেসব তথ্য তারা তাদের ডেটাবেইসে সংরক্ষণ করে রেখেছে। আরও কিছু কোম্পানি আছে, যারা অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ডিএনএ থেকে তথ্যসেবা প্রদান করে, যেমন নেভিজিনােমিকস, পাথওয়ে জিনােমিকস, জেন্টেল ল্যাব ইত্যাদি। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের নিয়ম অনুযায়ী ব্যক্তিগত সেবা দিতে সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে যেকোনাে সময় টেস্ট করা যেতে পারে।

ফিউচুরা জিনােমিকস (Futura Genomics) নামের কোম্পানিটি ফুসফুসের ক্যানসার, মেলানােমা, মাইগ্রেইন, আলঝেইমার, ব্রেস্ট ক্যানসার, ইউটেরাসের ক্যানসারসহ ২৮টি গুরুত্বপূর্ণ রােগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিন চিহ্নিত করে দিতে পারে। এরা অনলাইনভিত্তিক সেবা প্রদান করে। তাই পৃথিবীর যেকোনাে প্রান্ত থেকেই এদের সেবা গ্রহণ করা যাবে। ভেরিটাস জেনেটিকস নামের কোম্পানিটি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কোম্পানির সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আধুনিক জর্জ চার্চ। কোম্পানিটি শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন সেবা দেয়। এরাই প্রথম ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের খরচ এক হাজার ডলারের নিচে নিয়ে আসে। এদের বিভিন্ন সেবার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে 'মাইজিনােম', এই প্রজেক্টের লক্ষ্য হচ্ছে ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের ফলাফল স্মার্টফোনে প্রকাশ করা। এখানে অল্প খরচে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এবং ফলাফল বিশ্লেষণের সেবা রয়েছে। তাদের সাইটের ঠিকানা : www futuragenomics.com

আমেরিকাভিত্তিক কাউন্সিল (Counsyl) কোম্পানিটিও অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমআইটি টেকনােলজি রিভিউতে বলা হয়েছে, ৩ দশমিক ৬ শতাংশ দম্পতি সন্তান নেওয়ার আগে কাউন্সিলে জেনেটিক পরীক্ষা করিয়েছেন। তাদের অন্যতম সেবা হচ্ছে ভ্রণ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনাগত শিশুর কোনাে জেনেটিক রােগ যেমন সিস্টিক ফিব্রোসিস, ট্যাই-স্যাকস, সিকল সেল, পম্পেসহ অন্যান্য রােগের ঝুঁকি আছে কি না। এখানে খুব কম খরচে সেবা পাওয়া যায়। একজনের জন্য ৩৪৯ ডলার এবং দম্পতির জন্য মাত্র ৬৯৮ ডলার।

একজনের সঙ্গে আরেকজনের ডিএনএ সিকোয়েন্স শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ পার্থক্য থাকে। আর এই পার্থকের কারণে আমরা একজন আরেকজনের থেকে আলাদা। এই পার্থক্যের অন্যতম ফলাফল একই মেডিসিনে একেকজনের শরীর একেকভাবে রেসপন্স করে। প্রতিটি মেডিসিনের মেটাবলিজম এবং কার্যপ্রণালি ব্যক্তিভেদে আলাদা হবে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ফার্মাকোজিনােমিকস। ক্ষেত্রে এ পার্সোনালাইজড মেডিসিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে অনেক কোম্পানি পার্সোনালাইজড মেডিসিন উৎপাদন শুরু করেছে, যেমন এপিজাইম, হরাইজন, সােমা এনালাইটিকাস, বায়ােকার্টিস, টুইস্ট বায়ােসাইন্স, ইমারজিন এবি, সেরা প্রােগ্নোস্টিকস, ট্রিট ইউ প্রভৃতি।

অস্ট্রেলিয়ান মাইডিএনএ (MyDNA) প্রতিষ্ঠিত হয়
২০০৭ সালে। প্রতিষ্ঠাতা লেসেলি শেফিল্ড ১৯৮০ সাল থেকে ফার্মাকোজিনােমিকস নিয়ে গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে একটা মেডিসিন একজনের শরীরে কীভাবে মেটাবােলাইজড হবে, শরীর কীভাবে রেসপন্স করবে, কোনাে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, অন্য কোনাে রােগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় কি না, এসব বিষয় বিবেচনা করে তার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী মেডিসিন নির্বাচনে সাহায্য করে (www. mydna.life)। এই কোম্পানি থেকে যে কেউ অনলাইনে মাত্র ১৪৯ ডলারে সেবা নিতে পারে। ভার্জ জিনােমিকস নামে একটি কোম্পানি আছে, যারা শুধু মস্তিষ্কের রােগের নিরাময়ে কাজ করে। আলঝেইমার, এএলএস, পারকিনসন ইত্যাদি রােগে অনেকগুলাে জিন জড়িত থাকে। একটি মেডিসিন দ্বারা যতগুলাে জিন প্রভাবিত হয়, তাদের চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করা এদের কাজ। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। এখনাে অনেক রােগ আছে, যাদের যথাযথ চিকিৎসা এমনকি রােগ নির্ণয় করাও দুঃসাধ্য। এসব সমস্যা প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি প্রচুর জিনগত তথ্য সংগ্রহ করে ডেটাবেইস তৈরি করছে, তারপর তারা এসব তথ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় ঘটিয়ে রােগ প্রতিকারের সম্ভাবনা উন্মােচন করছে।

ব্রেন্ডন ফ্রেয়ের কোম্পানি ডিপ জিনােমিকস (Deep Genomics) একটা মানুষের ডিএনএতে যত সিকোয়েন্স পাওয়া যায়, সেগুলাের উঘাটনের নিশ্চয়তা দেয়। তাদের তৈরি সফটওয়্যার ডিএনএ সিকোয়েন্সে কোনাে একটি মিউটেশনের হাজার হাজার উদাহরণ দিয়ে নতুন একটি মিউটেশনের প্রভাব বিশ্লেষণ করে দিতে পারে। ডিপ জিনােমিকস একটি বিশাল ডেটাবেস তৈরি করেছে, যা থেকে ৩০০ মিলিয়নের বেশি মিউটেশনের প্রভাব সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে জিন থেরাপি ডিজাইন, ডিএনএ লেভেলে রােগ নির্ণয় এবং বিভিন্ন জেনেটিক রােগের ঝুঁকি যাচাই করা সম্ভব। ২০১৬ সালে আইবিএম ওয়াটসন হেলথ ও কুয়েষ্ট ডায়াগনষ্টিকস মিলে আইবিএম ওয়াটসন ফর জিনােমিকস নামে একটা সেবা চালু করে। এতে ওয়াটসনস আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে টিউমারের জিন চিহ্নিত করা হয় এবং প্রত্যেক রােগীর জন্য আলাদাভাবে যথাযথ চিকিৎসাপদ্ধতির পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্যানসারের রােগীদের আরও দ্রুত ও কার্যকরী চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ওয়াটসন ফর জিনােমিকসকে বায়ােটেক কোম্পানি ইলারিনয়াস ট্রসাইট টুমরের (Illumina's TruSight Tumor 170 tool) সঙ্গে একীভূত করা হয়। তাদের লক্ষ্য একজন রােগীর জিনােমিক ডেটা বিশ্লেষণ করে কয়েক মিনিটের মধ্যে রিপাের্ট প্রদান করে রােগীকে সবচেয়ে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া।

গুগল অ্যালফাবেটের উদ্যোগে ভেরিলি লাইফ সায়েন্স নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালের আগে এটি গুগল লাইফ সায়েন্সেস নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে কোম্পানিটি তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। কোম্পানিটির কাজ হবে অনেকটা গুগলের মতাে। বিভিন্ন রােগের হাত থেকে কীভাবে বাঁচা যায়, তা এদের ডেটাবেইস থেকে সহজেই যেন খুঁজে বের যাবে। এরা রােগ নিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতিও তৈরি করছে। একধরনের ডিজিটাল কনট্যাক্ট লেন্স তৈরি করেছে কোম্পানিটি, যার মাধ্যমে ব্লাড গ্লুকোজ পরিমাপ করা যায়।

ফাউন্ডেশন মেডিসিন নামের একটা কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করে যথাযথ চিকিৎসা পরামর্শ দেয়। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত রােসেটা জেনােমিকস হলাে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি আছে ইসরায়েলভিত্তিক গবেষণা ও উন্নয়নকেন্দ্রটির। অন্যদিকে কালারা জিনােমিকস কোম্পানিটি ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত জেনেটিক মিউটেশন বিশ্লেষণ করে। স্তন ক্যানসারের প্রধান দুটি জিন BRCA1, BRCA2-সহ ক্যানসার ঝুঁকি বাড়ায়, এমন আরও ১৭টি জিন বিশ্লেষণ করতে তারা মাত্র ৩৪৯ ডলার নেয়।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে ড. সেলিম খানের নেতৃত্বে মানুষের জিনােম সিকোয়েন্সিংয়ের একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি মাসে। বাংলাদেশে রােগনির্ণয়ের জন্য জেনেটিক তথ্য গবেষণার খুব বেশি সুবিধা এখনাে তৈরি হয়নি। তবে সম্প্রতি প্রভা হেলথ (Pravaa Health) নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিভিন্ন ক্যানসার, যেমন ফুসফুস, সার্ভিক্যাল, কোলন ক্যানসারসহ অন্যান্য টিউমারের জন্য মিউটেশন বিশ্লেষণ করছে। আশা করা যায়, অচিরেই বাংলাদেশে আরও উন্নত মানের সেবা চালু হবে। আর দেশের বাইরের কোম্পানিগুলাে যেহেতু অনলাইনভিত্তিক, তাই পৃথিবীর যেকোনাে প্রান্ত থেকে খুব সহজেই সেসব সেবা পাওয়া সম্ভব।

লেখক : উম্মে হাবিবা,
 গবেষক, প্ল্যান্ট বায়ােটেকনােলজি ল্যাব, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন