বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচ - Storybd3

Latest

বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র

সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২০

বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচ

বরিশালে চাকরির সুবাদে বছরখানেকের বেশি সেখানে থাকার সুযোগ হয় । তখন সেখানে এক বিশেষ মরিচের স্বাদ গ্রহণের  সুযােগ ঘটে। গাট্টাগােট্টা পেটফোলা, অগ্রভাগ সরু , কোঁচকানাে, আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু। শরীরের যে মরিচ জান্ধা না হলেও তার ঝালে চোখের জল করতে বাধ্য। তারপরও কেন যে সেখানকার মানুষের কাছে এ মরিচ এত জনপ্রিয়, তা আমার বােধগম্য হয়নি। কেউ কখনাে একটা মরিচ পুরাে খেতে পারে না, কয়েকজনে ভাগ করে একটা মরিচ খায়। একটি মরিচের দাম সময়বিশেষে ১০ টাকা পর্যন্ত উঠতে দেখেছি। গরম ভাত বা ভর্তার সঙ্গে এ মরিচ খাওয়ার বেশি চল দেখেছি বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরােজপুরে। সেখানে এ মরিচকে বলে 'বােম্বাই মরিচ'। ব্রিটিশ আমলে যা কিছু বড় বা বেশি, তাকেই 'বােম্বাই বিশেষণে চালিয়ে দেওয়ার একটি রেওয়াজ ছিল। হয়তাে সে রেওয়াজে তীব্র ঝালের কারণে এ মরিচের স্থানীয় নাম হয়েছে বােম্বাই মরিচ। কাচা মরিচের রং উজ্জ্বল আকর্ষণীয় সবুজ, পাকলে হয় কমলা বা টুকটুকে লাল। বরিশাল অঞ্চলে দেখেছি প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙিনাতেই দু-চারটা বােম্বাই মরিচের গাছ। বাজারেও বিক্রি হতে দেখেছি। কিন্তু মাঠে কখনাে চাষ হতে দেখিনি। তাহলে বাজারে এত মরিচ আসত কোথা থেকে? খোজ নিয়ে পরে জেনেছি, ব্যবসায়ীরা সেগুলাে নিয়ে আসতেন সিলেট থেকে।
আরাক-এর কামরা লঙ্কা আমাদের দেশে না মরিচবা বােম্বাই মরিচা মরিচের আকৃতি কিছুটা কামরাঙ্গার মতাে হওয়ায় হয়তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর উপন্যাসে এ মরিচকে বলেছেন কামাত লগা। তিনি এ মরিচ নিয়ে স্থানীয় তরুণীদের দ্বারা ঠাট্টা-মশার কথাও বলেছেন, 'ইতিমধ্যে একটি মেয়ে বড় একটা পাকা কামরাঙা লঙ্কা আনিয়া আমার পাতে দিয়া হাসিয়া বলিল—খান বাবুজি একটু লঙ্কার আচার। ভানুমতী শুধু আপনাকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, তা তাে হবে না। আমরা একটু ঝাল খাওয়াই।' মরিচকে স্থানীয় বাংলা ভাষায় লঙ্কা বলা হয়। আর কামরাঙ্গা লঙ্কার ঝাল যে কতখানি, তা না খেলে কেউ অনুমান করতে পারবে না।

এ দেশের বিভিন্ন স্থানে কামরাঙা মরিচ বিভিন্ন নামে পরিচিত। সিলেট অঞ্চলে এ মরিচ নাগা মরিচ নামে পরিচিত। ভারতের উত্তর-পূর্বাংশ ও আসাম রাজ্যে এ মরিচের ছড়াছড়ি রয়েছে। ভারতের নাগাল্যান্ড থেকে এ মরিচের আগমন বলে এর নামকরণ করা হয়েছে নাগা মরিচ। তবে শুধু নাগাল্যান্ড নয়, ভারতের আরও কিছু রাজ্যে এ মরিচ জন্মে। বিশেষ করে আসাম ও মণিপুর রাজ্যে এ মরিচ বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে সিলেট ও
বরিশাল অঞ্চলে এ মরিচ বেশি দেখা যায়। এ নাম ছাড়াও  এ মরিচকে ভূত মরিচ বলে। ঢাকায় এ মরিচের নাম ফোটকা মরিচ বা ফুটকা মরিচ। এই মরিচের আকৃতি ফুটকি বেগুন। ফোসকা বেগুনের মতাে বলে হয়তাে এরূপ স্থানীয় নাম হয়েছে। তীব্র ঝালের কারণে খুলনা অঞ্চলে একে বলে বিষ মরিচ। বরিশাল অঞ্চলে বলে বােম্বাই মরিচ। বরিশালে আরেক জাতের নাগা মরিচের চাষ হয়। তাকে বলে ঘৃত বােম্বাই বা ঘেত্ত বোম্বাই  মরিচ। সে মরিচে ঝালের পাশাপাশি ঘিয়ের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। বেশ তৃপ্তিদায়ক সে সুম্রাণ।

শ্রীলঙ্কায় এ মরিচ 'নাই মরিচ’ নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম কোবরা চিলি। কেউটে সাপের বিষের মতােই ভয়ংকর তীব্রতা রয়েছে এ মরিচের ঝালে। এ জন্য হয়তাে এর এ রকম ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে। অন্য নাম ঘােষ্ট পিপার বা ভূত জলােকিয়া। নাগা মরিচ বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচ, ২০০৭ সালে সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাগা মরিচকে বিশ্বের সবচেয়ে কাল মরিচ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা ট্যাবাস্কো সস থেকে ৪০১ দশমিক ৫ গুণ বেশি ঝাল। ট্যাবাস্কো সস লুজিয়ানার স্যাকলহেনি কোম্পানির তৈরি ট্যাবাস্কো মরিচের (Capsicum frutescens var. tabasco) একটি সস, যা ঝাল সস হিসেবে পরিচিত। ট্যাবাস্কো একটি ব্রান্ডেরও নাম।

মরিচ কতটুকু ঝাল, তা ল্যাবরেটরিতে এইচপিএলসি যন্ত্র ব্যবহার করে মাপা হয় স্কোভিলি হট একক (এসএইচইউ) দিয়ে। ঝালের তীব্রতা বােঝানাের জন্য ট্যাবাস্কে ব্লেড পেপার সসের সঙ্গে বিভিন্ন মরিচের ঝালের তুলনা করা হয়। ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচের এসএইচইউ শূন্য (০)। ট্যাবাস্কো রেড পেপার সসের এসএইচইউ ২৫০০ থেকে ৫০০০, সেখানে না মরিচের এস এইচইউ পাওয়া গেছে ১০,8১,৪২৭, যা ট্যাবাস্কো সস থেকে ৪০১ দশমিক ৫ গুণ বেশি। ইন্ডিয়ান ডিফেন্স ল্যাবরেটরিতে ২০০০ সালে পরীক্ষা করে এ তথ্য পাওয়া যায়।

 অবশ্য নাগা মরিচের এই ঝালের গৌরব অচিরেই হার মানে বিশ্বের আরও কিছু জাতের মরিচের কাছে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ২০১১ সালে ইনফিনিটি চিলিকে ঘােষণা করে বিশ্বসেরা ঝাল মরিচ হিসেবে। সে মুকুটও মাত্র এক বছরের জন্য থাকে ইনফিনিটি চিলির। ২০১২ সালে নাগা ভাইপার ও ত্রিনিদাদ মরুগা স্করপিয়ন ইনফিনিটির সে মুকুট নামিয়ে দেয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৭ আগস্ট ক্যারােলিনা রিপারকে ঘােষণা করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচ হিসেবে। নাগা মরিচ ছাড়া এর কোনােটিই আমাদের দেশে নেই। তাই নাগা বা বােম্বাই মরিচই এ দেশে সবচেয়ে ঝাল মরিচ।

সােলানেসি পরিবারের সদস্য নাগা মরিচের প্রজাতিগত নাম Capsicum frutescens হলেও অনেকেরই সন্দেহ যে এটি হয়তাে আসলে তা নয়, এটির প্রজাতি হয়তাে Capsicum fairnensis। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এর ডিএনএ পরীক্ষা করে মত দেওয়া হয়েছে যে নাগা মরিচের প্রজাতি আসলে এ দুটি প্রজাতির জানােটিই নয়, বরং এটি এই দুটি প্রজাতির একটি সংকর জাতি। নাগা মরিচের মধ্যে এ দুটি প্রজাতিরই জিন রয়েছে।

মরিচে কী এমন রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যে কারণে রিচ খেলে ঝাল লাগে? যেকোনাে স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য রিচ জ্বালাপােড়া অনুভূতির সৃষ্টি করে। দেহের যেসব কোষ লা মরিচের সংস্পর্শে আসে, সেখানেই এরূপ প্রদাহ সৃষ্টি হয়। বেশ কিছু রাসায়নিক যৌগ এই প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে ক্যাপসিনয়েডস  অন্যতম । মূলত ক্যাপসিসিন (৮-মিথাইল- ন-ভ্যানিলাইল-৬-ননএনামাইড) তাৎক্ষণিকভাবে এই এদাহ সৃষ্টি করে থাকে। বিশুদ্ধ ক্যাপসিসিন স্বাদগন্ধহীন কধরনের জোলাে মােমসদৃশ যৌগ। ক্যাপসিসিন ছাড়াও নারও কিছু রাসায়নিক যৌগ রয়েছে, যাদের একত্রে বলে ক্যাপসিনয়েডস। যখন মরিচ খাওয়া হয়, তখন ভ্যাপসিনয়েডস পেইন রিসেপ্টরের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে মুখগহ্বর ও গলায় ভেতরে প্রদাহ বা জ্বালাপােড়া অনুভূতি সৃষ্টি করে। রিসেপ্টর সে খবর মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। মস্তিষ্ক আবার সে খবর পেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং হৃৎকম্পন ছড়িয়ে দেয়, অশ্রুপাত ঘটায় ও এনডরফিন নিঃসরণ করে। এনডরফিন আনন্দ উদ্রেককারী একটি প্রাণরাসায়নিক যৌগ। সাপসিসিন রক্তের কোলেস্টেরল কমাতেও সাহায্য করে। গবেষক রে অ্যালাক্সের মতে, ক্যাপসিসিন ক্যানসার, বিশেষ করে প্রােস্টেট ক্যানসার, ত্বকের ক্যানসার ও অন্ত্রের ক্যানসার নিরাময় করতে পারে। দ্য আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্যান্সারের  এক গবেষণা প্রতিবেদনেও ক্যাপসিসিন প্রোস্টেট ক্যান্সার কোষ মেরে ফেলতে পারে বলে উল্লেখ   করা হয়েছে। চীন ও জাপানে গবেষণা করে দেখা গেছে, ক্যাপসিসিন সরাসরি লিউকেমিক কোষগুলোর বৃদ্ধি বোধ করতে পারে।

২০০৮ সালে এক গবেষণায় দেখা যায়, ক্যাপসিসিন সতর্ক করে দেয় যে কীভাবে এটিপি  উৎপন্ন শক্তি দেহের কোষ ব্যবহার করছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এটিপি হাইক্রোলাইসিসে SERCA প্রোটিন এই শক্তি ব্যবহার করে ক্যালসিয়াম আয়নকে সারকোপ্লাজমিক ঝিল্লিতে স্থানান্তর করে। কিন্তু ক্যাপসিসিন উপস্থিত থাকলে এই আয়ন চলাচল কমে যায়। ফলে এটিপি হাইড্রোলাইসিসের ফলে উৎপন্ন শক্তি দেয় থেকে তাপ আকারে বেরিয়ে যায়। এ জন্য বেশি ঝাল খেলে চোখ-কান গরম হয়ে ওঠে।

লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন